ছাগলনাইয়ায় ঐতিহ্যের নিদর্শন শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ, ত্রিপুরা শাসন ও সংগ্রামের ইতিহাস

Daily Inqilab ছাগলনাইয়া থেকে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন :

১৯ জুন ২০২৫, ১০:১৬ এএম | আপডেট: ১৯ জুন ২০২৫, ১০:১৬ এএম

 
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চম্পকনগর গ্রামে ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ। স্থানীয়ভাবে ‘ভাটির বাঘ’ নামে পরিচিত এই বীর পুরুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই সুড়ঙ্গটি আজও পর্যটকদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সুড়ঙ্গের একটি মুখ রয়েছে বাংলাদেশে, অপর প্রান্ত ভারতে—যা এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
 
এই সুড়ঙ্গ দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক। যদিও এর দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতি নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, তবুও স্থানীয় জনসাধারণের মতে এটি একটি প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ ছিল। কেউ কেউ আবার বলেন, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বা গোপন চলাচলের জন্য এই সুড়ঙ্গটি ব্যবহৃত হতো। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, এটি শমসের গাজীর পরিবারের নারী সদস্যদের নিরাপদে গোসলের জন্য পুকুরে যাওয়ার গোপন পথ ছিল এই সুড়ঙ্গ।
 
শমসের গাজীর পরিচয়: ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র শমসের গাজীর জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়া অঞ্চলে। তার পিতার নাম পীর মুহাম্মদ (মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান) এবং মাতার নাম কৈয়্যারা বিবি। মূলত, তাদের আদি নিবাস ছিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ওমরাবাদ পরগণার কচুয়া গ্রামে। দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের কারণে তার পরিবার ছাগলনাইয়ায় চলে আসে, যেখানে শমসের গাজীর পিতা জমিদার নাসির মন চৌধুরীর মুন্সি হিসেবে কাজ করতেন।
ছোটবেলায়ই শমসের গাজী পিতৃহারা হন। দারিদ্র্যের মাঝেও দুরন্ত স্বভাবের এই বালক তালুকদার জগন্নাথ সেনের আশ্রয়ে থেকে লেখাপড়া ও যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। যুবক বয়সে তিনি ডাকাত ও জলদস্যুদের দমন করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে জমিদার হন তিনি।
 
শমসের গাজীর ত্রিপুরা শাসন ও সংগ্রামের ইতিহাস:-
শমসের গাজী ছিলেন প্রজাবান্ধব শাসক। ফসলহানির কারণে কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে তিনি ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ত্রিপুরার মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের আদেশ অমান্য করে তিন বছর রাজকোষে খাজনা না দেওয়ায়, মহারাজ তার বিরুদ্ধে বাহিনী পাঠান। শমসের গাজী সেই বাহিনীকে পরাজিত করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরসহ বিশাল অঞ্চল দখলে নেন। এক যুগের বেশি সময় তিনি ত্রিপুরা শাসন করেন, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল চম্পকনগর।
 
শমসের গাজীর পতন ও রহস্যঘেরা মৃত্যু,১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। তখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, স্থানীয় কুচক্রী মহল এবং পরাজিত মহারাজ একজোট হয়ে শমসের গাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। ইংরেজদের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী চম্পকনগরে হামলা চালিয়ে তাকে পরাজিত ও বন্দি করে। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে আজও নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি—যা তাকে ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত করে।শমসের গাজীর ঐতিহ্যের নিদর্শন গুলোর মধ্যে রয়েছে ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা—শমসের গাজীর ভিটা, দীঘি, বাঁশের কেল্লার ধ্বংসাবশেষ, এবং সর্বোপরি এই রহস্যময় সুড়ঙ্গ। যদিও তার প্রাসাদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বড় একটি অংশ বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতরে রয়ে গেছে, তবে বাংলাদেশের অংশটিও যথেষ্ট ঐতিহাসিক ও পর্যটন সম্ভাবনাময়। প্রতিদিন শতশত পর্যটকরা এই সুড়ঙ্গ ও শমশের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন গুলো দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে।

বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিএনপি ক্ষমতার নয় দেশের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে: আবদুস সালাম

বিএনপি ক্ষমতার নয় দেশের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে: আবদুস সালাম

নাসিরনগরের দুই শাতেমের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ

নাসিরনগরের দুই শাতেমের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ

রাজবাড়ী‌তে শশুরকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করলো  জামাতা

রাজবাড়ী‌তে শশুরকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করলো জামাতা

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষ, নাটোরে আ.লীগের ১৭ নেতাকর্মী কারাগারে

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষ, নাটোরে আ.লীগের ১৭ নেতাকর্মী কারাগারে

৫ আগস্ট সরকারি ছুটি থাকবে: উপদেষ্টা ফারুকী

৫ আগস্ট সরকারি ছুটি থাকবে: উপদেষ্টা ফারুকী

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কিছু এলাকায় উন্নয়ন হয়নি : উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কিছু এলাকায় উন্নয়ন হয়নি : উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

২১ দিনে সেনা অভিযানে গ্রেপ্তার ৯৯৬

২১ দিনে সেনা অভিযানে গ্রেপ্তার ৯৯৬

যে একমাত্র শর্ত মানলে ইরানে হামলা চালানো থেকে সরে আসবেন ট্রাম্প!

যে একমাত্র শর্ত মানলে ইরানে হামলা চালানো থেকে সরে আসবেন ট্রাম্প!

যে একমাত্র শর্ত মানলে ইরানে হামলা চালানো থেকে সরে আসবেন ট্রাম্প!

যে একমাত্র শর্ত মানলে ইরানে হামলা চালানো থেকে সরে আসবেন ট্রাম্প!

খুলনায় ছাত্রী অপহরণকারী গ্রেফতার

খুলনায় ছাত্রী অপহরণকারী গ্রেফতার

ছাগলনাইয়া সীমান্ত দিয়ে ১১ জনকে পুশইন

ছাগলনাইয়া সীমান্ত দিয়ে ১১ জনকে পুশইন

উখিয়ায় নাফনদীর কিনারে পাওয়া গেছে এক অজ্ঞাত লাশ

উখিয়ায় নাফনদীর কিনারে পাওয়া গেছে এক অজ্ঞাত লাশ

টঙ্গীতে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে অস্ত্র ফেলে পালাল সন্ত্রাসী

টঙ্গীতে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে অস্ত্র ফেলে পালাল সন্ত্রাসী

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে কুলাউড়ার মুনার কৃতিত্ব

চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে কুলাউড়ার মুনার কৃতিত্ব

বাংলাদেশকে দুই প্রকল্পে ৬৪০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক

বাংলাদেশকে দুই প্রকল্পে ৬৪০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক

কটিয়াদীতে বেকারত্ব কমাচ্ছে অটোরিকশা বাহন

কটিয়াদীতে বেকারত্ব কমাচ্ছে অটোরিকশা বাহন

পঞ্চগড়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

পঞ্চগড়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, ইরানে মার্কিন হামলা প্রতিটি মোড়ে ঝুঁকিপূর্ণ

মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, ইরানে মার্কিন হামলা প্রতিটি মোড়ে ঝুঁকিপূর্ণ

২৫৩ জনের গুমের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কমিশন

২৫৩ জনের গুমের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কমিশন

পাঁচবিবিতে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ইউএনওর অভিযান

পাঁচবিবিতে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ইউএনওর অভিযান