“শ্রমজীবির উপার্জনই উৎকৃষ্টতর যদি সে সৎ উপার্জন করে।” (রাসুল সাঃ) পৃথিবীতে মানব শিশুজন্ম নেবার পর তার প্রথম ক্রন্দনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় তার ক্ষুধার কথা। তার বাঁচার অধিকারের কথা। পৃথিবীতে বাবা আদম ও মা হাওয়া আসার পর প্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হন তা হল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এর সমস্যা। এসব গুলোই অর্থনৈতিক সমস্যা। মানুষের জীবনে আজ যেসব সমস্যা ব্যাপক আকার নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল অর্থনৈতিক সমস্যা।

“শ্রমিক (লেবার) তারাই যারা কঠোর শ্রমম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নূন্যতম মজুরী লাভ করে যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য বা জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাই তারা দরিদ্র্য।

এ ধরনের একজন প্ররিশ্রান্ত শ্রমিক সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) বলেন “যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত সন্ধ্যা যাপন করে, সে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।”

সাধারণ সমাজের দরিদ্র শ্রেণীই অর্থাভাবে শ্রমিকের কাজ করে থাকে পুঁজিপতি ও শিল্পপতীদের দ্বারা তারা হয় শোষিত, নির্যাতিত। যথাযথ পারিশ্রমিকের অভাবে তারা দিনের পর দিন অতিবাহিত করে অনহারে অর্ধহারে। শ্রমিক শ্রেণীকে এ অবিার্য দারিদ্রের হাত থেকে রক্ষার জন্য রাসুল (সাঃ) শ্রমিক মালিক সকলকেই ভাই ভাই বলেছেন। তাই নিজেও শ্রমিক বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন।

প্রিয় নবী (সাঃ) বহু বছর মা খাদিজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে বকরী চরানোর মত কঠিন শ্রমের কাজ করেছেন। নবী (সাঃ) জানতেন বুঝতেন শ্রমিকের শ্রমের মর্যাদা। তিনি বলেছেন, “শ্রমজীবি ও উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু”।

অধীন শ্রমিক ও দাস-দাসীর প্রতি ভালো ও সমান ব্যবহারের তাকিদ দিয়ে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা যা খাবে তোমাদের অধীনস্থদের তাই খেতে দিবে, এবং তোমরা যা পরবে তাদেরকে তাই পরতে দিবে।” (বুখারী শরীফ)

মহানবী (সাঃ) শ্রমিককে মালিকের সমান মর্যাদা ঘোষনা করে বলেন, “এমন হওযা অস্বাভাবিক নয় যে, মর্যাদায় মালিকের তুলনাই শ্রমিকই শ্রেষ্ঠ। এটাও অসম্ভব নয় যে, অধীন দাসের ক্রিয়া কর্ম আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। (কানযুল উম্মান)

শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নে তিনি বলেন, “শ্রমিক কে এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদেরকে অক্ষম ও অকমর্ন্য বানিয়ে দেবে।” (তিরমীজী শরীফ) আরো বলেন, “তাদের ওপর ততখানিই কর্মের চাপ দেয়া যেতে যারে যতখানি তাদের সামর্থ্যে কুলায়। সাধ্যাতীত কোন কাজের নির্দেশ কিছুতেই দেওয়া যেতে পারে না। (মুসলিম-মুয়াক্তা)

শ্রমিকদের শোষনের হাত থেকে রক্ষার জন্য ঘোষণা করেছেন; “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার প্রাপ্য মিটিয়ে দাও। (ইবনে মাযা; বায়হাকি) তিনি আরো বলেছেন, “মুজরি নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ করবে না। (বায়হাকি)Ñবলেছেন, “শ্রমিকগণকে তাদের উৎপাদিত পণ্য থেকে অংশ প্রদান করো। কারণ আল্লাহর বান্দা এ শ্রমিকদের কিছুতেই বঞ্চিত করা যাবে ন্”া শ্রমিকের অধিকারে এ এক যুগান্তকারী ইতিহাস। (দ্রঃ বই ইসলামে শ্রমিকের অধিকার)।

জুলুম শোষণ বন্ধে বলেছেন, “তোমরা মানুষকে অত্যাচার এবং শোষণ করো না। নিশ্চয়ই যারা দুনিয়ায় মানুষের উপর শোষণ চালাবে, তাকে কিয়ামতের দিন মারাত্মক শাস্তি প্রদান করা হবে।” (দ্রঃ কিতাবুল খারাজ)

শ্রমিকদের সমস্যা নিরসনে তাদের অধিকার পূরণে ইসলাম বাস্তব ও ন্যায়ানুগ দৃষ্টি ভঙ্গি রাখে। রাসুল (সাঃ) তাদের সম্পর্কে বলেছেন, “এরা তোমাদের ভাই তোমাদের খেদমত করছে। আল্লাহ এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যার যে ভাই তার অধীনে রয়েছে তাকে যা সে নিজে খায় তা থেকে খেতে দিবে। যা নিজে পরে তাই তাকে পরাবে। আর যে কাজ তার জন্য অতিকষ্ট কর, সে কাজের বোঝা তার উপর চাপিয়ে দিও না। অগত্যা যদি যে রকম কাজ করতেই হয় তবে নিজ (স্বতঃপ্রবৃত) তাকে সাহায্য কর।” (বুখারী শরীফ-বইঃ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার)

ইসলাম মালিক কে সহনশীল হতে শিক্ষা দেয়। ক্ষমা সুন্দর মনোভাব নিয়ে শ্রমিকের দোষ-ত্রুটি মাফ করে দিতে উৎসাহিত করে। একদিন এক সাহাবী এসে নবী করীম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, “হুযুর চাকর খাদেমের অপরাধ কতবার ক্ষমা করব? গুনে, নবী করীম (সাঃ) চুপ করে রইলেন। সাহাবী পুনরায় তাই জিজ্ঞেস করলেন। তখন তাপিতদের পরম নির্ভর স্থল মোহাম্মদ (সাঃ) বলে উঠলেন প্রত্যেক দিন সত্তরবার হলেও তাকে ক্ষমা করে দিও। এরা যে তোমার ভাই। (তিরমিযী শরীফ)

নবী করীম (সাঃ) ফরমানÑ“মজুর ও শ্রমিক কে তার শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য হতে ও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুর কে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না। এখানে শ্রমিককে এতটা উন্নীত করেছেন যে, তাকে তিনি আল্লাহর শ্রমিক বলে অভিহিত করেছেন।

প্রখ্যাত সাহাবী আবুযর গিফারী (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর খাদেম ছিলেন। একদিন কাজের চাপ কিছু বেশী হওয়ায় খানিকটা রাত করেই তিনি মসজিদে নববীর এক কোণে শুতে গেলেন। ঐ দিন তিনি একটু বেশী পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই নবী (সাঃ) তাঁকে সঙ্গ সুখের আনন্দ দানের জন্য নিজেও মসজিদে তশরীফ নিয়ে এলেন। আবুযর ততক্ষণে শুয়ে পড়েছেন। নবী করীম (সাঃ) তাঁকে আঙ্গুলির ইশারায় জাগালেন। আর একান্ত সহানুভুতির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,.......‘আবু যর ঐ দিন তুমি কি করবে যেদিন তোমাকে এই মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হবে?”। দরবারে নববীতে আবু যরের অনেকটা অকৃত্রিম সহজ সম্পর্ক ছিল। তিনি সরলভাবে বলে উঠলেন-“তলওয়ার খুলে দাড়াবো। আর যে আমাকে এই শান্তির নীড় থেকে বের করে দিতে চাবে তার গর্দান উড়িয়ে দিব।”

নবী করীম (সাঃ) তখন হাত উঠালেন, দোয়া করলেন, “আল্লাহ আবু যরকে তুমি মাফ করে দাও।” আরও কিছু নসীহত মূলক কথা বলে তিনি উঠে এলেন। (মসনদে আহমদ) (বই: ইসলামে শ্রমিকদের অধিকার)

হুজুর (সাঃ) এর দোয়ায় আবু যরের শ্রান্তমন যে কতটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজকের এই সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতিতে যদি কোন মালিক শ্রমিকদের খোঁজ খবর নিজে থেকে নেয়, সুখে দুঃখে সান্তনার বাণী নিয়ে আসে তবে অতি সহজেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যেতে পরে। কিন্তু পুঁজি বাদের ন্যাক্কার জনক মানসিকতার কারণে শিল্প মালিক এমন অহমিকায় ভুগছে যে খোঁজ নেয়া তো দুরের কথা, তাদেরকে মানুষ মনে করে না। ইসলাম শিল্পপতিকে তাদেরকে নিজের মতই ভাবতে শিক্ষা দেয়।

হাদীস শরীফে আছে, একদিন সাদ আনসারী (রাঃ) নবীজীকে সালাম দিয়ে মুসাহাফা করলেন। নবীজী (সাঃ) তার হাতে জড় বা (ঘাটা) অনুভব করে বললেন, “তোমার হাতে কি? জবাবে তিনি বললেন, হুজুর, আমি শ্রমিক, অন্যের কাজ করে হালাল উপার্জন করি। তাই আমার হাতে জড় হয়েছে। প্রিয় নবী তার হাতে চুমু খেলেন এবং বললেন, নিজের হাতে কামাই হতে হালাল আর কোন কামাই নেই। এ জন্যেই তো আমাদের নবীর প্রশংসায় বিশ্বের দুই নেতা মার্কস ও লেনিন বলেছেন, “মোহাম্মদ ছাড়া পৃথিবীর কেউ জীবনে কোন শ্রমিকের হাতে চুমু খেয়েছে তার প্রমাণ কি ইতিহাস দিতে পারবে?

মজদুর শ্রেণির অধিকার সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) এর কতটুকু গভীর অনুভুতি ছিল এর কিছুটা আন্দাজ হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত রেওয়াত দ্বারা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “মহা প্রয়ানের সময় ও নবী করীম (সাঃ) এর যবান মুবারক থেকে এ শব্দটি বাঙময় হয়ে উঠেছে নামাজের খেয়াল রেখো, আর যারা তোমাদের অধীনে আছে তাদের অধিকার ভুলে যেয়ো না। (ইবনে মাজাহ)

নবীজীর আদর্শ এই; শ্রমিক যে কাজ নিজে করবে সে কাজ সম্পর্কে তার জ্ঞান ও শিক্ষা ও শারীরিক শক্তি থাকা উচিত। সে মালিকের কাজ নিজের মত করে সুন্দর ভাবে করবে। কোন ফাঁকি দিবে না। রুজীকে হালাল করবে।

পৃথিবীর সমস্ত সম্পত্তি মালিকানা পরিবর্তন হলেও যদি মানুষের ঘৃণা, শোষণ ও অপরকে অধীস্থ করার মানসিকতা কাজ করে তাহলে দারিদ্র ও শোষণ কোনদিন ঘুচবে না। তাই আমাদের ফিরে আসতে হবেÑহযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আদর্শে ও শিক্ষায়, যার কোন বিকল্প পথ নেই।

তাই একদিকে দেখি ভুখা নাঙ্গা মানুষ
আর অন্য দিকে আকাশ ছোয়া অট্টালিকা;
কি জবাব দিবে সেদিন হে ধনী?
যখন না খেয়ে মরে তোমার ভাই বোনেরা।
সাম্যবাদের কবি নজরুল ইসলামের কবিতা দিয়ে শেষ করছিঃ
“মানুষের ঘৃণা করি
ওরা কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুমিছে মরিমরি
পুঁজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল
মুর্খেরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”॥