আজকাল বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-সেমিনার কিংবা পত্র-পত্রিকা এবং ইসলামী ওয়াজ মাহফিল বা ধর্মীয় সভা-সম্মেলনে ‘মওলানা’ ও ‘মাওলানা’ শব্দ দুটি নিয়ে যথেচ্ছ কথা-কথান্তর, আলোচনা-সমালোচনা, বদানুবাদ এমনকি পত্র-পত্রিকাগুলোতেও এর দ্বৈত ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব বিশৃঙ্খল ব্যবহারবিধি বা বিভ্রান্তি নিরসনে আজকের লেখার অবতারণা। এখানে ‘মওলানা’ এবং ‘মাওলানা’ শব্দের উৎস, ব্যুৎপত্তি, অর্থ, ব্যবহারিক পার্থক্য উদাহরণসহ বিশ্লেষনের চেষ্টা করা হবে।

বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার শব্দের আধিপত্য কম নয়। বাংলা ভাষায় ধর্মীয় ও আরবি-ফারসি শব্দের প্রভাবও অত্যন্ত গভীর। এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলো আরবি-ফারসি উৎস থেকে বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে প্রচলিত হয়েছে। এদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হচ্ছে ‘মওলানা’ বা ‘মাওলানা’। এই দুটি শব্দ একই উৎস থেকে এলেও উচ্চারণ, বানান এবং ব্যবহারগত দিক থেকে কিছু পার্থক্য আছে- যা সাধারণ পাঠক বা ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।

শব্দের উৎস ও ব্যুৎপত্তি: (ক) ‘মওলানা’ শব্দটি আরবি শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘প্রভু’, ‘স্বামী’, ‘পৃষ্ঠপোষক’, ‘উস্তাদ’ বা ‘ওস্তাদ’ অথবা ‘অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি’। এই শব্দটি ইসলামী সভ্যতা ও ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে একটি সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুসলিম সমাজে একজন আলেম বা ধর্মীয় ব্যক্তিকে সম্মান জানানোর জন্য ‘মওলানা’ উপাধি দেওয়া হয়। (খ) ‘মাওলানা’ শব্দটিও একই আরবি উৎস ‘মাওলা’ থেকে উদ্ভূত। তবে বাংলা ভাষার ধ্বনিগত অভিযোজনের ফলে এটি অনেক সময় ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। বিশেষত গ্রামীণ ও কথ্য বাংলায় এই শব্দটি ‘মাওলানা’ উচ্চারিত হয়। এটি মূলত ‘মওলানা’ শব্দেরই একটি উচ্চারণগত রূপান্তর।

শব্দ দুটির শাব্দিক অর্থ ও প্রয়োগে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে উভয় শব্দই একজন ইসলামি প-িত বা আলেমকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যেমন- আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বুভুক্ষ মানুষের প্রতিনিধি খ্যাতনামা রাজনীতিক মজলুম জননেতা ‘মওলানা ভাসানী’। বিখ্যাত সুফি সাধক ও কবি ‘মাওলানা রুমি’। সামাজিক ব্যবহারেও শব্দ দুটির পার্থক্য লক্ষনীয়। বই-পত্র, সাংবাদিকতা, একাডেমিক রচনায় ‘মওলানা’ বানানটি বেশি প্রচলিত- কারণ এটি আরবি মূল বানানের নিকটবর্তী। অন্যদিকে, ‘মাওলানা’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় কথ্য ভাষায়- যেমন সাধারণ বক্তৃতা, গ্রামীণ ভাষা ইত্যাদিতে।

উভয় শব্দের ‘মও’ বনাম ‘মা’ উচ্চারণগত বিশ্লেষণে দেখা যায়- ‘মও’ ধ্বনিটি বাংলা ভাষায় কিছুটা ভারী এবং আরবি ধ্বনির কাছাকাছি। এ কারণেই প্রমিত বাংলা বা সাহিত্যিক রচনায় এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। ‘মা’ ধ্বনিটি সহজ ও সরল- যা সাধারণ জনগণের মধ্যে দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- প্রমিত: মওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ। কথ্য: মাওলানা সাহেব কাল জুমার খুতবা দিয়েছেন।

বাংলা একাডেমি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সাধারণত ‘মওলানা’ বানানটিকেই প্রমিত ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। বাংলা অভিধানে ‘মাওলানা’ শব্দটি আছে কিন্তু সেটিকে ‘মওলানা’ শব্দের একটি চলতি রূপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেই উভয় শব্দের বানানগত পার্থক্য ও বাংলা একাডেমির দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।

সাহিত্য ও ইতিহাসে দুটি শব্দেরই ব্যবহার পাওয়া যায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ধর্মীয় রচনায় ‘মওলানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। একইভাবে মওলানা শব্দটি বাংলার বহু কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনায় ‘মাওলানা’ রূপও দেখা যায়, বিশেষত লোকবক্তৃতার অংশে।

ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির নামের আগে মাওলানার পরিবর্তে মওলানা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- মওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এ উপ-মহাদেশে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে এ নবজাত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ধারায় এক বিরাট ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। সঙ্গত কারণেই এতদাঞ্চলের জনগণের মধ্যে গভীর উপলব্ধি দেখা দেয়- ব্রিটিশ প্রবর্তিত ত্রুটিপূর্ণ ও ভারসাম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং একে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার সাথে সংগতিপূর্ণ ও সময়োপযোগী করে তুলতে হবে। জনগণের এ অনুভূতির প্রতি অনুকূল সাড়া দিতে গিয়ে সরকার জনগণের শিক্ষা সমস্যাকে ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রদানের জন্য সতের সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক মওলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ পূর্ববঙ্গ প্রস্তাব নং ৫৯ মোতাবেক গঠিন ‘পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণগঠন’ নামে পরিচিতি ও কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কমিটি কর্তৃক পেশকৃত সুপারিশমালা ‘আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৫২’ নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন বড় মাপের ধর্মীয় নেতা ও কৃষকনেতা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

আবার মাওলানা শব্দটির ব্যবহারও কম নয়। যেমন- পারস্যের সুফি সাধক মাওলানা রুমি। জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি একজন ফার্সি কবি। তাকে মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি নামে ডাকা হলেও শুধু ‘রুমি’ নামে বেশি জনপ্রিয়। রুমিকে একজন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও আধ্যাত্মিক গুরু মনে করা হয়। তিনি তের শতকের একজন কবি ছিলেন। তার লেখা ‘মসনবী’ বহুল পঠিত বই। তার অনেকগুলো অমীয় বাণী রয়েছে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে- ‘যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা কর, তবে রাত থেকে লুকিয়োনা। যদি তুমি একটি গোলাপ আশা কর, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়োনা, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিওনা।’

শব্দ দুটি ব্যবহারে আঞ্চলিকতা ও ব্যবহারগত পার্থক্যও রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষার ব্যবহারে এই দুই শব্দের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ঢাকা ও শহরাঞ্চলে ‘মওলানা’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। গ্রামাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে সাধারণত ‘মাওলানা’ শব্দের ব্যবহার বেশি। এটি মূলত শিক্ষার স্তর ও মিডিয়ার প্রভাবের ওপর নির্ভর করে।

আধুনিক মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে অনলাইন সংবাদমাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিও, ইসলামি বক্তৃতা ইত্যাদিতে ‘মাওলানা’ বানানটি বেশি দেখা যায়- কারণ এটি সহজ ও জনপ্রিয় উচ্চারণ অনুসরণ করে। তবে বই ও প্রবন্ধে এখনো ‘মওলানা’ বানানটি ব্যবহৃত হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।